তৈরি করেছেন - ডাঃ ভগদত্ত খীসা
বি. এ. ক্লাশে পাঠ্য একটা সমাজ বিজ্ঞান বই আছে। লিখেছেন এক জাঁদরেল প্রফেসর। অন্তত ডিগ্রী দেখে তাই মনে হয়। লেখা আছে-- "চাকমাদের প্রধান খাদ্য ভাত ও মদ" । উনি কোনদিন চাকমা দেখেছেন কিনা জানিনা। তবে সাধারণ বুদ্ধি বিবেচনা সম্পন্ন কোন ব্যক্তি- মদকে প্রধান খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করবেন এমন ধারণা অচিন্তনীয়। মদ নেশার জিনিস- পানীয়। অনেক দেশের লোকেরা খায়। আকণ্ঠ পান করে মাতলামি করে। মগ ভর্তি বিয়ার খায়। বিয়ার খাওয়া নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতা হয়। তাই বলে, সে দেশে কারো প্রধান খাদ্য মদ- এ কথা কোথাও লেখা নেই।

সেই পুস্তকের আরেক জায়গায় আছে- "চাকমাদের চাচাতো ভাই বোনদের বিয়ে হয়"।
তাজ্জব কথা! অবাক কাণ্ড! চাকমা সমাজে 'গর্বা', 'খিল্যা' কুটুম্ব নিয়ে অনেক বাধা-নিষেধের বেড়া-জাল আছে। এই চাচাতো ভাই বোনদের বিয়ে নিয়ে কড়া নিষেধাজ্ঞা বিদ্যামান। যেহেতু একই গোষ্ঠী, একই রক্ত। বিয়ে করা কল্পনাও করা যায় না।
যেহেতু বইটা পাঠ্য পুস্তক- বেশ উঁচু ক্লাশের এবং মানসম্পন্ন ছাত্রদের জন্য- সেক্ষেত্রে ভুল তথ্য পরিবেশনা রীতিমত অপরাধের সামিল। কোন চাকমা ছাত্র সমাজ বিজ্ঞান পরীক্ষা দিতে গিয়ে এই সব ভুল তথ্য যদি নাকচ করে দেয়- তবে সে নির্ঘাত ফেল করবে।
আর এক ভদ্রলোক লিখলেন- "চাকমারা স্নানের পর ভিজা গামছা দিয়ে গা মোছে"। মনে হয় এমন কথা কেউ কোনদিন শুনেনি। অদ্ভূত এমন কাণ্ড কেউ কোনদিন দেখেনি। তামাম উপ-মহাদেশ গ্রামের লোকেরা গামছা পরে স্নান করতে যায়। স্নানের পর সেই গামছা নিংড়ে গা মোছে। শুকনো টার্কিশ তোয়ালে দিয়ে গা মোঝামোছি এটাতো সেইদিনের ব্যাপার। পাশ্চাত্যের আমদানী। নূতন বাথরুম সংস্কৃতি।
১৯৫৪-৫৫ সালের দিকে- আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র- এক ভদ্র মহিলা খবর দিলেন। তিনি চাকমা ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চান। চাকমাদের ব্যাপারে কিছু লেখালেখি করবেন। তথ্যাদি দরকার তার। আমাদের ব্যাপারে উৎসাহী লেখক ও শ্রোতা পেয়ে গাঁটের পয়সা খরচ করে রিকশায় চললাম নারিন্দা নাকি টিকাটুলি। তিন কথায় আলাপ শেষ। কাপের চা- টুকুও খাওয়া শেষ হয়নি। চাকমা ছেলেদের প্রিয় খেলা কি? চাকমারা কি শুটকি খায়। এইসব কথা।

পরে দেখি- স্কুলের সমাজ পাঠের একটা পাঠ্যপুস্তক বের হল। একটা অধ্যায় আছে সেখানে। বিষয়- দেশ-বিদেশের ছেলেমেয়েরা আকাশে ঘুড়ি উড়ায়। চাকমা ছেলেদের প্রিয় খেলা- 'ঘুলা খারা' ও 'নাদেয় খারা', চাকমারা পঁচামাছ ও নাপ্পি খায়।
চাকমাদের এত ভাল গুণাগুণ থাকা সত্ত্বেও পাঠ্যপুস্তকরূপ স্থান পেল চাকমারা নাপ্পি খায়, পঁচামাছ খায়। কোমলমতি বালক-বালিকারা এসব পড়ে সারাজীবন মনে রাখবে অন্তরে সঞ্চিত হবে এক বিবমিষা ঘৃণা। অদূর ভবিষ্যতে ওরা কোন চাকমাকে দেখে ঘৃণায় বমি না করলে আমি অবাক হব।
রাঙ্গামাটি হাইস্কুলে আমাদের এক মাস্টার মশাই ছিলেন। জিতেন বাবু। বাড়ি খুব কাছে- চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ায়। পাকিস্তান কায়েম হওয়ার প্রথম দিকে তিনি রাঙ্গামাটি বদলি হন। তিনি শুনেছিলেন- চাকমারা নাকি মানুষ খায়। সরকারী চাকুরী। না এসে উপায় নেই। প্রাণটা হাতে করে রাঙ্গামাটি এসে দেখছেন- সব ফক্কা। শুনা কথার কোন দাম নেই। চাকমারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তারা নিরামিষাশী- এ কথা বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু মানুষ খায়- নৈব নৈবচ। বরং তার চাকমা সহকর্মী আরাজেন্টিনা বাবু, প্রভাত বাবু অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী এবং সজ্জন।
একজন শ্রদ্ধেয় আত্মীয়ের কথা মনে পড়ে। সরকারী কর্মচারী।এখন পরলোকে। গল্পছলে তিনি প্রায় বলতেন বিস্তর রস করে। বাসে এক ভদ্রলোক তাকে জিজ্ঞাস করেছিলেন- "আপনি কি চাকমা?"
হেসে তিনি জবাব দিলেন- "জ্যা"।
মুহুর্তেই ভদ্রলোক তাকে বলে বসলেন,- "চাকমারা নাকি মানুষ খায়?"
হেসে তিনি জবাব দিলেন- "জ্যা"।
মুহুর্তেই ভদ্রলোক তাকে বলে বসলেন,- "চাকমারা নাকি মানুষ খায়?"
দু'তিন গরম হয়ে গেল আমার আত্মীয়ের। অহমিকায় ঘা লাগল চটেমটে বললেন,- "সরকারে- পুলিশে যদি না ধরত, তবে আপনাকে একটু চেখে দেখতাম"।
চাকমাদের একটা স্বভাব- তারা সঞ্চয় করে না। নগদ যা পায়, দু'হাতে খরচ করে। জুম বা কৃষি খেত থেকে পাওয়া এক বছরের খোরাকী, ছ-মাসে উড়িয়ে দেয়। এজনৌ তাদের দোষ দেওয়া যায় না। অরণ্য প্রকৃতিতে তারা আজন্ম লালিত পালিত। প্রকৃতির ভাণ্ডার থেকে আহরণ করে এই শিক্ষা তারা পেয়েছে প্রকৃতি উজাড় হয় না। আজ যেটুকু সংগৃহীত হল- কাল আবার তা পরিপূর্ণ হবে। অফুরন্ত তার খনি। তাই সঞ্চয়ের দরকার নেই।

ইংরাজ প্রশাসকেরা লক্ষ্য করেছেন- চাকমাদের নগদ টাকার তহবিলের দায়িত্ব দিতে নেই। তাহলে তহবিল তছরুপের দিয়ে তারা বিপদে পড়তে পারে। যেহেতু সঞ্চয়ের অভ্যাস নেই, নগদ টাকা হাতে পেয়ে হাত নিশপিশ করে। তারা খরচ করে ফেলে। এখানকার মৌজার দায়িত্বে নিয়োজিত হেডম্যানরা জায়গা-জমির খাজনা উশুল করেন। এই টাকা সরকারের কাছে জমা দেওয়ার আগে অনেকে খরচ করে ফেলেন। অনাদায়ী অর্থের দায়ে পড়ে অনেক হেডম্যান মৌজা ছেড়ে পার্বত্য ত্রিপুরায় পালিয়ে যেতেন। পার্বত্য ত্রিপুরা তখন করদ রাজ্য। বৃটিশ সীমানার এক প্রকার বাইরে। তখন ইংরাজ প্রশাসকেরা অনেক তদ্বির করে তাদের ফিরিয়ে আনতেন।
ইদানিং চাকমাদের নিয়ে টেলিভিশনেও তেলেসমাতি কাণ্ড হচ্ছে। 'তথাপি' নামে একটা ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত হয়েছিল। নাটকের চরিত্রে আছে এক চাকমা যুবক। শুল্ক বিভাগের কর্মচারী, তাকে দিয়ে যে সংলাপ করানো হয়- সেটা না বাংলা না চট্টগ্রামীয়। চাকমা তো নয়-ই।
সরকারী কর্মচারী। চাকুরীর যোগ্যতা নিদেন পক্ষে এস এস সি তো বটেই। এমতাবস্থায়, সে বাংলা বলতে পারবে না- আমার ধারণার বাইরে। তাকে দিয়ে জগাখিচুড়ি মার্কা ভাষায় যে রস করা হয়- সেটা নেহাৎ "খেত মার্কা" গ্রাম্যতা, রসেরও একটা সীমা আছে।
আগেকার দিনে পৌরাণিক নাটকে একটা চরিত্র থাকত। জংলি সর্দার। গায়ে বাঘ মার্কা কাপড়ের ফতুয়া। মাথায় পালকের টুপি। বাঁধে তার ধনুক। হিন্দী-বাংলা দো-আঁশলা ভাষাংশ চলত তার সংলাপ "ছো, শিকার ভাগিয়ে গেল। হাসি কুচ্ছু করতে পাললেই না"।

জংলি সর্দারের অন্তরটা ছিল মহৎ। যুদ্ধে পরাজিত রাজপুত্র কিংবা পালিয়ে আসা নায়ককে তিনি আশ্রয় দিতেন। সাহায্য সহযোগীতা প্রদান করতেন। প্রয়োজনে প্রাণও দিতেন। কিন্তু আধুনিক নাটকে চাকমা চরিত্রটি হচ্ছে ভিলেন। পেটে পেটে কুবুদ্ধি।
ইদানিং বাংলা গল্পেও চাকমাদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। চাকমা তরুণী- যে নাকি ফরেস্ট গার্ড-এর মেয়ে- নিয়তকরা নিয়ে সাম্পান বেয়ে সারাদিন কাপ্তাই হ্রদে ঘুরে বেড়ায়। চাকমা মেয়েরা হাল-দাঁর বেয়ে নৌকা চালায়। সাম্পান বেয়ে ঘুরে বেড়ায় কোথাও শুনিনি।
বিদ্রদাশ বড়ুয়া তার গল্পের পরিশেষে চাকমা তরুণ-তরুণীকে নিয়ে চুম্বুনের কথা লিখেছেন। নায়ক-নায়িকা ঠোঁটে ঠোঁটে মিলিয়ে চুম্বনরত। গল্প শেষ। বিপ্রদাশ বাবুকে চুপি চুপি বলি- চাকমারা ঠোঁটে ঠোঁটে মিলিয়ে চুম্বন করে না। তারা পরস্পর শুঁকে। নাকে নাকে ঘর্ষণ করে।
চাকমাদের পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন সুগত চাকমা। তার চাকমা পরিচিতি নামক পুস্তকে। কিন্তু ক'জন পরিচিত হয়েছে। জনাব আবদুস সাত্তার লিখেছেন- কাছের মানুষ আপন জন, উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর পরিচয় হারানোর জন্য। কিন্তু আক্ষেপ- আমরা ধরাছোঁয়ার বাইরে মানুষ হয়েই রইলাম।
________________________________
________________________________
লেখকঃ ডাঃ ভগদত্ত খীসা (১সেপ্টেম্বর ১৯৩৩- ২ডিসেম্বর ২০০২) একজন খ্যাতিমান চিকিৎসক, প্রাবান্ধিক, ছড়াকার এবং চিন্তাবিদ।
পোস্ট সংগ্রহঃ 👇
Comments